বাংলা সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিন হলো পহেলা ফাল্গুন। এটি বসন্ত ঋতুর প্রথম দিন, যা নতুন প্রাণ ও আনন্দের বার্তা নিয়ে আসে। প্রকৃতি যেন এক নতুন রঙে সেজে ওঠে, আর বাঙালির হৃদয়ে বেজে ওঠে উৎসবের আনন্দ। ২০২৫ সালের পহেলা ফাল্গুন পড়েছে ১৪ ফেব্রুয়ারি, যা এক বিশেষ মাত্রা যোগ করছে এই উৎসবে, কারণ একই দিনে পালিত হবে ভালোবাসা দিবস।
পহেলা ফাল্গুন কবে ও কেন উদযাপিত হয়?
পহেলা ফাল্গুন বাংলা ফাল্গুন মাসের প্রথম দিন, যা সাধারণত গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের ফেব্রুয়ারি মাসের ১৩ বা ১৪ তারিখে পড়ে। ২০২৫ সালে এটি ১৪ ফেব্রুয়ারি উদযাপিত হবে।
বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এই দিনটি বিশেষভাবে পালিত হয়। এটি মূলত বসন্তের আগমনী বার্তা বহন করে, যা দীর্ঘ শীতের পর প্রকৃতিকে নতুন করে জাগিয়ে তোলে।

বসন্তের আগমন: প্রকৃতির নবজাগরণ
শীতের শুষ্কতা কাটিয়ে প্রকৃতিতে আসে নবজীবনের স্পর্শ। গাছে গাছে নতুন পাতা গজায়, আর রঙিন ফুলের বাহারে প্রকৃতি হয়ে ওঠে মোহনীয়। পলাশ, শিমুল, কৃষ্ণচূড়ার লাল আভায় চারপাশ ভরে যায়। দখিনা বাতাসে এক মিষ্টি শিহরণ জাগে, আর কোকিলের ডাক জানান দেয় বসন্তের আগমন।
-
বসন্ত শুধু প্রকৃতির নয়, মানুষের মনেও এক নতুন উচ্ছ্বাস সৃষ্টি করে। বাংলা সাহিত্যে, বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামের রচনায় বসন্তের অনন্য বর্ণনা পাওয়া যায়। কবিগুরু লিখেছেন—
-
“এসো হে বৈশাখ, এসো এসো, তাপস নি:শ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে।”
পহেলা ফাল্গুন উদযাপন ও তার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশে পহেলা ফাল্গুন উদযাপন একটি দীর্ঘ ঐতিহ্য বহন করে। এটি বসন্ত উৎসব হিসেবে পরিচিত এবং মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে উদযাপন শুরু হয়। পরবর্তীতে জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদ এর বিস্তৃতি ঘটায় এবং এখন এটি সারাদেশে উদযাপিত হয়।
বিশেষ করে তরুণ সমাজের মধ্যে এই উৎসবের আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। তারা বাসন্তী রঙের পোশাক পরে, ফুলের মালা পরে উৎসবের আনন্দে মেতে ওঠে। এদিনে চারুকলার বকুলতলায় গান, কবিতা, নৃত্য ও আবৃত্তির মাধ্যমে বসন্তকে বরণ করা হয়। ঢাকার শাহবাগ, বইমেলার প্রাঙ্গণ, ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবরসহ নানা স্থানে বসন্ত উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়ে।

২০২৫ সালের পহেলা ফাল্গুন ও ভালোবাসা দিবস একসাথে
২০২৫ সালের পহেলা ফাল্গুন আরও বিশেষ একটি কারণে আলোচনায় থাকবে। এবার এই দিনটি ভালোবাসা দিবসের সাথেও মিলে গেছে। ফলে একদিকে বসন্তের আনন্দ, অন্যদিকে প্রেমের উদযাপন—সব মিলিয়ে একটি রঙিন উৎসবে পরিণত হবে এই দিনটি।
বাংলাদেশে ভালোবাসা দিবসের জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে। তরুণ-তরুণীরা তাদের প্রিয়জনদের সঙ্গে এই দিনটি উদযাপন করে। বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট, ক্যাফে ও পার্কে মানুষের ভিড় বাড়বে। বসন্তের রঙের সাথে ভালোবাসার উষ্ণতা মিলেমিশে এক অসাধারণ আবহ তৈরি করবে।

বসন্ত উৎসবের প্রধান আকর্ষণ
১. চারুকলা অনুষদের শোভাযাত্রা: পহেলা ফাল্গুনের প্রধান আকর্ষণ হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বসন্ত শোভাযাত্রা। এখানে রঙিন পোশাকে সজ্জিত মানুষ, শিল্পকলা প্রদর্শনী ও সাংস্কৃতিক পরিবেশনার মাধ্যমে বসন্তকে বরণ করা হয়।
- রবীন্দ্র সরোবর ও শাহবাগের অনুষ্ঠান: ঢাকা শহরের রবীন্দ্র সরোবর, শাহবাগ, ও বইমেলার আশপাশে বসন্ত উৎসবের বিশেষ আয়োজন থাকে। নাচ, গান ও আবৃত্তির মধ্য দিয়ে বসন্তের সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা হয়।
- বসন্তের পোশাক ও সাজসজ্জা: এই দিনে বাসন্তী রঙের শাড়ি, পাঞ্জাবি, ফুলের মালা ও আলতা পরিধান করা হয়। বিশেষ করে তরুণীরা ফুলের গয়না ও হাতে আলতা লাগিয়ে সাজগোজ করে বসন্তের আনন্দ উপভোগ করে।
- বইমেলা ও সাংস্কৃতিক উৎসব: পহেলা ফাল্গুনের সময় অমর একুশে বইমেলাও জমে ওঠে। নতুন বই প্রকাশ, কবিতা আবৃত্তি, সাহিত্য আলোচনা এবং লেখকদের উপস্থিতি বইপ্রেমীদের জন্য বাড়তি আনন্দ যোগ করে।
- ফুল ও উপহারের রমরমা ব্যবসা: এই দিনে ফুলের চাহিদা আকাশছোঁয়া থাকে। গোলাপ, গাঁদা, রজনীগন্ধা, ও কদম ফুলের বিপুল বিক্রি হয়। পাশাপাশি বসন্ত ও ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন উপহারের দোকানেও ব্যস্ততা বেড়ে যায়।

গ্রামবাংলায় বসন্ত উৎসব
শহরের মতো গ্রামেও বসন্ত উৎসব উদযাপিত হয়, যদিও এর রূপ কিছুটা ভিন্ন। গ্রামাঞ্চলে বৈশাখী মেলা, পুতুল নাচ, যাত্রাপালা, হাডুডু প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার মাধ্যমে বসন্তকে বরণ করা হয়। বয়স্করা পিঠা-পুলি তৈরি করেন, আর তরুণ-তরুণীরা নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেন।
পরিবেশ রক্ষা ও সচেতনতা
বসন্ত উৎসব উদযাপনের পাশাপাশি আমাদের পরিবেশের প্রতি যত্নশীল হওয়া জরুরি। অতিরিক্ত ফুল সংগ্রহ ও রাসায়নিক রঙের ব্যবহার পরিবেশের ক্ষতি করতে পারে। তাই আমাদের উচিত প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রেখে উৎসব পালন করা।